তোমরা যারা ২৫-৩০ বা তারচেয়ে কমবয়সী তাদের জন্য কিছু কথা:
০১) জীবনে যখন যেখানে আনন্দ করা সম্ভব, করো। পরিবারের সাথে, বন্ধুদের সাথে, প্রিয় মানুষের সাথে। যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। বয়স যতো বাড়বে ততো রেসপনসেবলিটি আর পারিপার্শ্বিকতার চিপায় তুমি চাপা খেতে খেতে তিতা হয়ে যাবা, 'পরে'র জন্য ফেলে রাখা কিছুই করার সময়/সুযোগ পাবা না।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেখবা আনন্দ একইসাথে রেয়ার এবং এক্সপেন্সিভ হয়ে যায়। সময় থাকতে আনন্দ করো যেনো পরে পস্তাতে না হয়।
০২) তুমি যদি নন-বিজনেস ব্যাকগ্রাউন্ডের হও তাহলে বেসিক ফাইনান্স, এ্যাকাউন্টিং এগুলা শেখা শুরু করো। ইউটিউব, অনলাইন কোর্স যেখান থেকে পারো শেখো, এখন রিসোর্সের অভাব নাই। পুরা দুনিয়া চলে যে টাকার উপরে, সেই টাকা কিভাবে চলে সেটা জানা খুবই জরুরি। না, বড়লোক হওয়ার জন্য না, তুমি যেনো ফাইনান্সিয়ালি ভুল ডিসিশান নিয়ে অথবা কোনো কিছু ডিসাইড করতে না পেরে লংরানে মারা না খাও সেজন্যই বেসিক বিজনেস রিলেটেড নলেজ থাকা খুব জরুরি।
সায়েন্স/ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে বিজনেস রিলেটেড নলেজ দরকার নাই, এইটা ভয়াবহ ভুল কথা। যতো বয়স বাড়বে, ততো বুঝবা।
০৩) যদি টক্সিক রিলেশনে থাকো এবং সেটা বুঝতে পারো! তাহলে যতো দ্রুত পারো সেটা থেকে বের হও। এই রিলেশনশিপ যে খালি প্রেমিক প্রেমিকার তা না, এটা বন্ধু বান্ধবের হতে পারে, স্বামী স্ত্রীর হতে পারে, পরিবারের বা আশেপাশের কারোর সাথে হতে পারে।
তোমার যতো বয়স বাড়বে ততো বুঝতে পারবা টক্সিক রিলেশনশিপ লং রানে একটা জিনিসই দেয়, ট্রমা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেই ট্রমার সাথে যুক্ত হয় মেন্টাল স্ট্রেস। যতো বেশি টানবা, 'দেখি না আরেকটু' মনে করবা; ট্রমা আর স্ট্রেস ততো বাড়বে।
০৪) বন্ধু হয় স্কুল/কলেজ পর্যন্ত, ব্যাস। এরপর তোমার ক্লোজ রিলেশন, ভালো রিলেশন হতে পারে কারোর সাথে কিন্তু সেখান থেকে বন্ধু হওয়া সম্পর্কের পরিমাণ অনেক কম, অধিকাংশ সময় শূন্য। বন্ধুত্ব খুব দামি জিনিস, এটা সবার সাথে হয় না, খুব অল্প কিছু মানুষের সাথে হয়।যে সবাইকে বন্ধু বলে সে আসলে কারোর বন্ধু না এবং তার আসলে কোনো বন্ধু নাই।
বন্ধুত্বকে সম্মান দিতে পারা, সম্পর্ককে ভ্যালু দেয়া মানুষ সময়ের সাথে সাথে তোমার জীবনে ব্লেসিং হিসাবে থাকবে। অন্যদিকে সেল্ফ রেসপেক্টহীন, বেহায়া টাইপের মানুষকে বন্ধু হিসাবে রাখলে ৩ নাম্বারে বলা কেইস হবে, হোং মাং সাং খাবা নিশ্চিত।
০৫) সঞ্চয় করা এবং সেটাকে বাড়ানোর উপায় শেখো। বাঙ্গালি মিডলক্লাস সঞ্চয় বলতে শিখায় টাকা ব্যাংকে/আলমারিতে রাখা। এইটাই একমাত্র সঞ্চয়ের উপায় না এবং সম্ভবত সবচেয়ে খারাপ উপায়গুলার একটা। টাকা হাতে রাখা জরুরি তবে সব টাকা হাতে রাখার যে মেন্টালিটি আমাদের হতদরিদ্র প্যারেন্টস শেখায় সেটা আমাদের সবচেয়ে খারাপ যে জিনিসটা দেয়, সেটা হলো বিনিয়োগ করার ব্যাপারে ভয়।
আমরা ছোট থেকে এই ভয় নিয়ে বড় হই এবং যখন নিজেদের হাতে টাকা আসে তখন এই ভয় অনেক কাজ করতে, সুযোগ নিতে বাধা দেয়। ২ নাম্বার পয়েন্টে বলা শিক্ষাগুলা তোমাকে এই ধরনের পরিস্থিতিতে না পড়তে হেল্প করবে।
০৬) বেসিক সায়েন্স(ম্যাথমেটিকস, ফিজিক্স, বায়োলজি), জিওগ্রাফি, ফাইনান্স(আবারো!!), জেনারেল নলেজ এইগুলা একজন সাধারণ বুদ্ধিমান মানুষ হওয়ার জন্য জানা থাকা জরুরি। জেনারেল নলেজ থাকলে অনেক কিছুর কনটেক্সট বোঝা সহজ হয়ে যায়, অনেক ব্যাপারের সহজে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। এর সাথে ক্রিটিকাল থিংকিং, লজিকাল রিজনিং সম্পর্কে জানা এবং এগুলা আয়ত্ব করার সর্বাত্মক চেষ্টা করা জরুরি। এইসব জিনিস যে জীবনে চলার পথে কতো জরুরি সেটা হয়তো সাদা চোখে দেখা যায় না কিন্তু এগুলা করতে না পারলে পদে পদে ধরা খাওয়ার চান্স আছে।
তারসাথে অতি অবশ্যই এমপ্যাথি শেখা। অনেকেই সিম্প্যাথি আর এমপ্যাথিকে এক করে ফেলে। এই দুইটা জিনিস কি, এদের মধ্যে পার্থক্য কি, দুইটার কোনটা কখন কোথায় কিভাবে দেখাতে হবে সেটা বোঝা জরুরি।
০৭) তুমিই একমাত্র মানুষ না যে কষ্টে আছে, আশেপাশে যাদের দেখতেছো হাসিমুখ নিয়ে আছে, এদের সবাই কোনো না কোনো কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তুমিই একমাত্র না যার ব্রেকাপ হইছে, যার রেজাল্ট খারাপ হইছে, মা/বাপ ঝাড়ি দিছে, অফিসে এ্যাপ্রেইজাল আটকায়ে গেছে, চাকরি পেতে পেতেও পাওনি। তুমি অন্য সবার মতোই, আমরা সবাই সবার মতোই। খালি আমাদের কষ্টের বর্ণ, গন্ধ আলাদা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে কষ্টের লিস্ট বড় হবে, ছোট না।
আরেকটা জিনিস উপলব্ধি করতে পারা খুব জরুরি। তোমার দু:খ একান্তই তোমার ব্যক্তিগত, এটা বাইরের কেউ বুঝবে না, বুঝাতেও যেয়ো না। তোমার দু:খ তোমাকে একা হ্যান্ডল করতে হবে এটা মেনে নাও, জীবন সহজ হবে।
০৮) যতো বড় হবা, রেসপনসেবলিটি ততো বড় হবে। এমন না যে তুমি পালায়ে বাচতে পারবা, রেসপনসেবলিটি যেটা ঘাড়ে আসার সেটা আসবেই, টুডে অর টুমরো। তারপর একসময় এমন বয়সে আসবা যখন দেখবা আশেপাশের কাছের মানুষজন এক এক করে যাওয়া শুরু হবে। কয়েক দিন/মাস/বছর পর যখন বাড়ি যাবা; দেখবা আজ ও অসুস্থ, কাল সে নাই।
বড় হওয়া মানে লেখাপড়া করে চাকরি বাকরি করে সংসার করা, বাচ্চা পয়দা করা না। বড় হওয়া মানে নিজের আপনজনদের চোখের সামনে অসুস্থ হতে দেখা, এক এক করে চলে যেতে দেখা! কিছু কিছু নাম্বার থেকে আসবে না কোনো ফোন' বুঝতে পারা।
০৯) পাওলো কোয়েলহো'র একটা কথা আছে যে তুমি যদি কোনো কিছু মন থেকে চাও তাহলে পুরা দুনিয়া তোমাকে সেটা এনে দেয়ার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। আমি 'আগার কিসি চিজ কো দিল সে চাহো... ডায়লগটা জানি। ঐটা শাহরুখ খানের কথা না(সরি ফর দ্যা হার্টব্রেক), কোয়েলহোর কথার হিন্দি তরজমা।
তো যা বলছিলাম, এইটা একটা বাখওয়াজ, বাংলায় বললে 'বা*র আলাপ'! তুমি দিল সে চাও আর লান্ড সে, যা চাবা তার সবই পাবা না। বরং বাস্তবতা উল্টা, জীবনে যা চাও তার ম্যাক্সিমামই পাবা না। আবার এমন অনেক কিছু পাবা যেটা কখনোই চাও নাই। জীবন চুতিয়া, ও তোমাকে বাকে বাকে সারপ্রাইজ দিবে। বয়স যতো বাড়বে, তুমি অভ্যস্ত হয়ে যাবা, সারপ্রাইজে অবাক হওয়ার চান্সও ততো কমবে।
জীবন ফেইরিটেল না, কারান জোহরের মুভি না। জীবন মোটাদাগে অনুরাগ কাশ্যাপের মুভি, কিছু কিছু সময় কুবরিকের; কড়া, সাসপেন্সফুল।
১০) শুনতে অবাক লাগতে পারে কিন্তু তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ইনভেস্টমেন্ট গাড়ি, বাড়ি না; তোমার লাইফ পার্টনার। তোমার পরিবার চুজ করার সুযোগ উপরওয়ালা তোমাকে দেয় না, লাইফ পার্টনার চুজ করার সুযোগ দেয়। এইটা সিনসিয়ারলি চুজ কইরো।
এক বয়সে মনে হবে চেহারাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তারপর আস্তে আস্তে মনে হবে চেহারা দিয়ে তো খালি হবে না; মানুষটার কথাও বলতে পারতে হবে, আমার কথা বুঝতে পারতে হবে, আমাদের কথা বলার মতো কথা থাকতে হবে। আরও পরে গিয়ে মনে হবে আমার পরিবারকে আপন ভাববে, আমাদের বাচ্চার জন্য ভালো প্যারেন্ট হতে পারবে এমন মানুষ দরকারি। একটা সময় বুঝতে পারবা যে চেহারা আসলে খুবই নগণ্য একটা ফ্যাক্টর, মেন্টাল ম্যাচিং না হলে বাকি সব অর্থহীন।
তোমার পার্টনার ভালো হলে, আন্ডারস্ট্যান্ডিং ঠিক থাকলে বাকিসব ম্যানেজ করা যায় লাইফে। উল্টাটা হলে মিলিয়ন ডলারের বাড়ি, গাড়ি সব তুচ্ছ হয়ে যায়। যে মানুষ ঘরে ফিরে শান্তি পায় না তার জন্য আলাদা দোজখের দরকার নাই, জীবনই তার জন্য নরক।
দুই বছর চালাবা যে মোবাইল সেইটা চুজ করতে যে পরিমাণ রিসার্চ করো তার হাজারগুণ বেশি রিসার্চ করা দরকার জীবনসঙ্গী চুজ করার জন্য। এইটা লং-টার্ম খেলা, ম্যারাথন; স্প্রিন্ট না। এইখানে চয়েজে ভুল করলে জীবন মেক সিওর করবে তুমি যেনো বুঝতে পারো যে তুমি চুতিয়া!!
১১) পরিবার পরিবারই। যতোদিন পরিবারের সাথে আছো, যতো বেশি পারো সময় কাটাও। যতো বড় হবা; তোমার নিজের জগত হতে থাকবে, পরিবারের সাথে না চাইলেও দুরত্ব হবে এবং সেটা সময়ের সাথে বাড়বে। তারপর এক সময় দেখবা তুমি বাড়িতে নাই, আজ বাবা নাই, কাল মা অসুস্থ, পরশু ভাই/বোন চলে যাবে দূরে বা বিদেশ। ইদে চান্দে ঐ বাড়িতেই যাবা অথচ কথা বলার কেউ থাকবে না।
শুক্রবারের দিন জুম্মার নামাজের পর সবাই একসাথে বসে ভাত খাওয়া বা এক রুমে পরিবারের সবাই মিলে হাসি তামাশা করা যে কি পরিমাণ দামি সেটা সময় তোমাকে বোঝাবে এবং খুব রূঢ়ভাবে বোঝাবে। তাই সময় থাকতে পরিবারের সাথে সময় কাটাও যতো বেশি পারো।
এরপর একদিন একটা কল আসবে, অপরপ্রান্ত থেকে একজন বলবে 'বাড়ি আসো, অমক আর নাই'! এই যে অমকের না থাকা, এই যে চিরস্থায়ী শুন্যতা, এই যে খবরটা শোনার পর দীর্ঘ যাত্রা প্রিয়জনকে শেষবারের মতো দেখার জন্য, 'কতো কথা বলার ছিলো অথচ বলা হলো না'র হাহাকার নিয়ে বাকিজীবন বেচে থাকা।
এটাই অ্যাডাল্টহুড, এটাই জীবন।
Follow Us Google News
View (34,994) | Like (0) | Comments (0)